ফারুক হোসেন মজুমদার:
নাট্য সংস্কৃতির বিরাট অংশ জুড়ে বিরাজমান নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘আজ রবিবার’ নাটক। ১৯৯৫ সালে নির্মিত এই নাটকটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুগ্ধ করে যাচ্ছে। হয়তো যুগের পর যুগ এভাবেই মানুষ মনে রাখবে কালের সাক্ষী ‘আজ রবিবার’।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের অমর সৃষ্টি হিসেবে বিখ্যাত হলেও এই নাটকটির পরিচালক মনির হোসেন জীবন। চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে আলাপকালে পরিচালক মনির হোসেন জীবন গল্পে গল্পে শোনালেন কীভাবে ‘আজ রবিবার’ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। জানিয়েছেন অজানা অনেক গল্প।
তবে স্পষ্ট করে মনির হোসেন জীবন জানিয়েছেন, হুমায়ূন আহমেদ কখনও তার নির্মাণে নাক গলাতেন না। একাধিকবার তিনি সংলাপ সংশোধন করেছিলেন। নির্মাতা হিসেবে তার পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। চলুন সেই গল্প শোনা যাক মনির হোসেনের মুখ থেকেই…
১৯৯৩ সালে হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয়। সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করতাম। স্যারের ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমাতে ভাড়াটে সহকারী পরিচালক ছিলাম। তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্যাকেজ আন্দোলয় হয়। টিভির লিস্ট করা আর্টিস্ট, প্রযোজকদের নাটক শুধুমাত্র প্রচার হতো। তখন শবনম পারভীন আমাকে প্যাকেজ ফোরাম কমিটিতে যুক্ত করেন। সেই আন্দোলনের সৈনিক আমিও ছিলাম। প্রেসক্লাবের সামনে রাজপথে স্লোগান দিতাম।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ধারাবাহিক ‘শিল্পী’, পরিচালক ছিলেন মামুনুর রশিদ। সেই নাটকের প্রধান সহকারী ছিলাম। তখন আহমেদ ইউসুফ সাবের স্যার, বরকত উল্লাহ স্যার, মোহন খান স্যার তাদের সঙ্গে কাজ করতাম। তখন হুমায়ূন স্যার নুহাশ চলচ্চিত্রের জন্য ভালো পরিচালক খুঁজছিলেন। তৎকালীন স্বনামধন্য ডিওপি আনোয়ার হোসেন বুলু ভাইয়ের মাধ্যমে হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। পরে স্যারের সঙ্গে ‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকে প্রথম প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করি।
স্যার আমার উপর খুশী হয়ে ‘আজ রবিবার’ নাটকটি পরিচালনা করতে দিয়েছিলেন। আমি অবাক হয়েছিলাম, কান্না করেছিলাম। ‘আজ রবিবার’ নাটক দিয়েই টিভি মিডিয়াতে পরিচালক হিসেবে আমার আত্মপ্রকাশ। এজন্য আমি স্যারের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ। এতগুলো বছর পরেও আমাকে যারা চেনেন তারা বলেন ‘আজ রবিবার’ নাটকের পরিচালক। তখন খুশীর সীমা থাকে না। স্যার যেভাবে আমাকে ‘আজ রবিবার’ লিখে দিয়েছিলেন আমি চেষ্টা করেছিলাম সেভাবে ফুটিয়ে তোলার।
আমরা সেট বানিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত শুটিং করতাম। স্যার মাঝেমাঝে শুটিংয়ে যেতেন। মেকিং নিয়ে স্যার কখনও কিছু বলতেন না। কিন্তু সংলাপ ইমপ্রোভাইস করতে দিতেন। বিভিন্ন জায়গায় উনি আমাকে ‘আজ রবিবার’র পরিচালক বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন।
একটা মজার অভিজ্ঞতা জানাই। ‘আজ রবিবার’ অভিনেতা ফারুক আহমেদের প্রথম নাটক। ওই নাটকের একটি দৃশ্যে ফারুক আহমেদ দরজার ছিদ্র দিয়ে তাকাতেন। ছিদ্র দিয়ে দেখার আইডিয়াটা হুমায়ূন স্যারের আইডিয়া। স্যার সেদিন শুটিং দেখছিলেন। স্যার আমাকে বলছিলেন, ফারুককে কি একটা সত্যি সত্যি থাপ্পড় খাওয়ানো যায়? আমি বলি, অবশ্যই যায় স্যার। এভাবে দৃশ্য দুবার ঠিকভাবে হওয়ার পরেও আলী যাকের ভাইকে বলে ফারুক ভাইকে অরিজিনাল থাপ্পড় খাওয়াই। এছাড়া সুজা খন্দকার এয়ার ফোর্সে চাকরী করতেন। তাকে একদিন মেকাপ নিয়ে বসিয়ে রেখেছিলাম। এভাবে স্যার এসে মজা করতেন।
‘আজ রবিবার’ নাটক মানুষ এত পছন্দ করেছে হুমায়ূন স্যারের গল্প ও চিত্রনাট্যের কারণে। আমি হয়তো সেইটা ভালোভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি মাত্র। তাই কাজটি ভালো হওয়ার জন্য বেশী ক্রেডিট হুমায়ূন স্যারকে দিতে চাই। উনি আমাকে দারুণভাবে গাইড করেছিলেন। তবে মেকিংয়ের ব্যাপারে কিছু বলতেন না। সংলাপ নিয়ে সংশোধন করে দিতেন।
এখনও ভালো ভালো নাটক হচ্ছে। তবে এতো এতো চ্যানেল, ইউটিউব মানুষ কোনটা রেখে কোনটা দেখবে? তবে হ্যাঁ শিল্প সাহিত্য নির্ভর নাটক কম হচ্ছে। আগে বলা হতো এ নাটক দর্শক দেখবে না, গান মানুষ পছন্দ করবে না। কিন্তু এখন বলে এই নাটক গান পাবলিক খাবেন না। নাটক গান কি খাওয়ার জিনিস? এগুলোতে কষ্ট পাই।
আমি আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আমি নিরহংকার একজন মিশুক মানুষ। স্বাধীন চলচ্চিত্র নামে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান আছে। সেখান থেকে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। কয়েক শ প্যাকেজ নাটক টেলিফিল্ম বানিয়েছি। আজ রবিবারের শিল্পীদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। ফারুক, ডাক্তার এজাজ, শামীমা নাজনীন প্রায়ই আমার নাটকে অভিনয় করে। চ্যানেল নাইনে ‘খণ্ডচিত্র’ নামে একটি সিরিয়াল প্রচার হচ্ছে। এছাড়া এসএ টিভিতে ‘বহ্নিশিখা’ নামে আরেকটা সিরিয়াল করতে যাচ্ছি।